Tuesday, December 6, 2016
ওয়াকফ কেন এবং কিভাবে করা যায়
সরকার ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে ১৯৬২ সালে ওয়াকফ অধ্যাদেশ -১৯৬২ জারী কারে। ওয়াকফ বলতে অধ্যাদেশের ২ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন মুসলমান কর্তৃক ধর্মীয়, পবিত্র বা দাতব্য কাজের উদ্দেশ্যে তার স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি স্থায়ীভাবে উৎসর্গ করাকে বুঝায়। তবে কোন অমুসলিমও একই সম্পত্তি একই উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে পারেন।
ওয়াকিফ: যিনি সম্পত্তি উৎসর্গ করে তাকে ওয়াকিফ বলে।
ওয়াকফ দুই প্রকার: ১) ওয়াকফ লিল্লাহ ও ২) ওয়াক্ফ আল-আওলাদ
ওয়াকফ লিল্লাহ: ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে অর্থাৎ পরকালে শান্তির আশায় হইকালে জনগনের কল্যাণে যে ওয়াক্ফ করা হয় তাকে ওয়াকিফ লিল্লাহ বলে।
ওয়াকফ আল-আওলাদ: কোন ব্যক্তি ’তার সম্পত্তি ওয়াক্ফ কওে এর আয় হতে আংশিক বা সম্পূর্ণরুপে তার বংশধরদের/ পরিবারের সদস্যদেও এমনকি তার নিজের ভরন-পোষণের ব্যবস্থা করতে পারেন। এরুপ ওয়াক্ফই হর ওয়াকফ আল-আওলাদ।
যে সব উদ্দেশ্যে ওয়াকফ করা যায়:
মক্কা শরীফের হাজীদের জন্য বোরাত বা বোডিং হাইজ নির্মাণ, ঈদগাহ নির্মাণ, মাদ্রাসা, খানকা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর ব্যয় নির্বাহ, হজ্জ পালনে সাহায্য করা, গরীবদের সাহায্য করা। ওয়াকিফ ও তার বংশধর ভরন পোষণ ইত্যাদি উদ্দেশ্যে সম্পত্তি উৎসর্গ করা যায়।
ওয়াকফের উপাদান সমূহ নিম্নরুপ:
১. ওয়াক্ফের উদ্দেশ্যে সম্পত্তি উৎসর্গ করতে হবে।
২. ওয়াক্ফ ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে হতে হবে।
৩. ওয়াক্ফের উদ্দেশ্যে সম্পত্তি উৎসগ অবশ্যই চিরতওে হতে হবে।
৪. ওয়াক্ফিকে উৎসর্গকৃত সম্পত্তি বৈধ মালিক হতে হবে।
৫. ওয়াক্ফিকে প্রাপ্তবয়ষ্ক ও সুস্থ মতিষ্ক হতে হবে।
৬. ওয়াক্ফ অবশ্যই শর্তমুক্ত হতে হবে।
ওয়াক্ফের বিষয়বস্তু: স্থাবর বা অস্থাবর উভয় ধরনের সম্পত্তিই ওয়াকফ করা যায়। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে যেমন- কোম্পানির শেয়ার, সরকারী ঋনপত্র, নগদ অর্থ ইত্যাদি।
ওয়াক্ফ প্রশাসক: সরকার ওয়াক্ফ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রন ও ব্যবস্থাপনার জন্য ওয়াক্ফ অধ্যাদেশ এর ৭ ধারা অনুসারে ওয়াক্ফ প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে থাকেন। যিনি ওয়াক্ফ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন কওে থাকেন।
ওয়াক্ফ প্রশাসক এর দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ
১। ওয়াক্ফ প্রশাসক ওয়াক্ফ ও এর তহবিল পরিচালনার জন্য ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন কানে। তিনি এই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পারন করেন। (ধারা- ১৯, ২০)
২। প্রশাসক সরকারের অনুমতিক্রমে এবং ওয়াক্ফ এর কল্যাণে/ উন্নতিকল্পে ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তি হস্থান্তর করতে পারে।(ধারা-৩৩)
৩। প্রশাসক উপযুক্ত কারন সাপেক্ষে মোতায়াল্লীকে অপসারন করতে পারেন।(ধারা-৩২)
৪। প্রশাসক তার প্রতিনিধির মাধ্যমে বা জেলা প্রশাসক এর মাধ্যমে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। (বাস্তব্যে জেলা প্রশাসকই ওয়াক্ফ প্রশাসকের পক্ষে দায়িত্ব পালন করেন।(ধারা- ৩৪, ৩৬)
৫। ওয়াক্ফ প্রশাসকের কোন আদেশে কেউ সংক্ষুদ্ধ হইলে তিনি জেলা জজের আদালতে আপিল করতে পারেন। (ধারা- ৩৫)
মোতায়াল্লী নিয়োগ:
ওয়াক্ফ পরিচালার জন্য গঠিত কমিটির সদস্য সচিবের বা ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবস্থাপকের ভূমিকায় যিনি থাকেন তাকেই বলে মোতায়াল্লি। মোতায়াল্লি সাবালক ও মানসিকভাকে সুস্থ হবেন।
মোতায়াল্লী নিয়োগ প্রক্রিয়া নিম্নরুপ:
ওয়াকিফ নিজে মোতাল্লী হতে পারেন।
ওয়াকিফ সম্পত্তির সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক মোননীত হতে পারেন।
ওয়াকিফের মৃত্যুকালীন ঘোষণা দ্বারাও কোন ব্যক্তি মোতায়াল্লী হতে পারেন।
আধ্যাত্মিক কার্যক্রম না থাকলে মাহিলাও মোতায়াল্লী নিযুক্তি হতে পারবেন।
প্রশাসক মোতায়াল্লী নিয়োগ করতে পারেন।
মোতায়াল্লীর দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ
ওয়াক্ফ সম্পত্তি প্রশাসকের দপ্তরে (ঢাকার ইস্কাটনে) তালিকাভূক্ত করা।
প্রতিবছর ১৫ জুলাই এর মধ্যে পূর্ববর্তী অর্থ বছরের আয় ও ব্যয়ের হিসাব প্রশাসকের নিকট পেশ করা।v
আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা।v
ওয়াক্ফ সম্পত্তি হস্থান্তার এর প্রয়োজন হলে প্রশাসকের পূর্বানুমতি নেওয়া।
ওয়াক্ফ সম্পত্তির আয়ের ৫% বার্ষিক চাঁদা প্রশাসকের দপ্তওে জমা দেওয়া।
ওয়াক্ফনামায় উল্লেখিত সমস্যাবলী যথাযথভাবে পালন করা।
ওয়াক্ফ সম্পত্তি রেজিষ্ট্রেশনঃ সম্পত্তি হস্তান্তর আইন – ১৮৮২ এর বিধান মতে ওয়াক্ফকৃত স্থাবর সম্পত্তির মূল্য ১০০ টাকার বেশী হলে তা রেজিষ্টী করা বাধ্যতামূলক। তবে অস্থাবর সম্পত্তি মৌখিকভাবেও ওয়াক্ফ করা যায়।
ওয়াক্ফ প্রত্যাহার : উইলের মাধ্যমে ওয়াক্ফ সৃষ্টি হয়ে থাকলে ওয়াকিফ তার মৃত্যুর পূর্বে যে কোন সময় তা প্রত্যাহর করতে পারেন। তবে ইউল ব্যতিত অন্য কোন ক্ষেত্রে ওয়াক্ফি ওয়াক্ফ সম্পত্তি প্রত্যাহার করতে পারেন না।
ওয়াক্ফ করা বাধ্যতামূলক: মোহামেডনস ল অনুযায়ী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে ঈদগাহ, কবরস্থান, ইমামবাড়ী, মাদ্রাসা ও মসজিদের জন্য জমি দান করলে তা অবশ্যই ওয়াক্ফ করতে হবে। অন্যদিকে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে পূর্ণ অর্জনের লক্ষে যে সম্পত্তি উঃসর্গ করে তাকে দেবোত্তর সম্পত্তি। দেবোত্তর সম্পত্তি যিনি পরিচালনা করে তাকে সেবাইত বলে। সেবাইত দেবত্তর সম্পত্তি হস্থান্তর করতে পারে না। ধর্মমন্ত্রালয়ের অধীনে একটি দেবোত্তর সম্পত্তি সেল আছে। উক্ত সেল থেকে এরুপ সম্পত্তির সার্বিক তত্ত্বাবধান করা হয়।
ওয়াক্ফ সম্পত্তি হস্থান্তরঃ ধর্মীয় প্রতিষ্টান এর সুবিধার জন্য দূরবর্তী স্থানের জমি বিক্রয় নিকটবর্তীস্থানে জমি ক্রয়ের জন্য ওয়াক্ফ প্রশাসক এর পূর্বানুমতি নিয়া ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিক্রয় করা যায়।
ওয়াক্ফ সম্পত্তি তালিকাভূক্তির নিয়মঃ যে কেউ ওয়াক্ফ সম্পত্তি তালিকাভূক্তির জন্য ওয়াক্ফ অধ্যাদেশ এর ৪৭ ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিষ্ঠান যেমন মাজার লাভজনক হওয়ার কারণে তার লাভজনক এড়ানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে যে কেউ তালিকাভূক্তির জন্য আবেদন করতে পারে।
ওয়াকফ আইন এর বিষয়বস্তু
ইসলামি আইন অনুযায়ী ওয়াকফের অর্থ কোনো মুসলমান কর্তৃক চিরস্থায়ীভাবে কোন সম্পত্তি ধর্র্মীয়, দাতব্য বা পূর্ণের কাজে উৎসর্গ করা। লিখিত ও রেজিস্ট্রকৃত দলিল, মৌখিক দলিল ও দীর্ঘকাল ব্যবহারের ভিত্তিতে কোন সম্পত্তি ওয়াকফে পরিণত হয়।
ওয়াকফ দুই প্রকার; জনসাধারণের ওয়াকফ এবং ব্যক্তিগত ওয়াকফ। ওয়াকফ করার সাথে সাথে আল্লাহর উপর মালিকানা বর্তায়। মোতাওয়াল্লি পরিচালনার অধিকার প্রাপ্ত হয়। ইসলামের প্রাথমিক
যুগে আরব দেশে কোন ওয়াকফ ছিল না। ওয়াকফ হাদিসের মাধ্যমে জন্মলাভ করে।
সম্পত্তি ওয়াকফের মাধ্যমে ধর্মীয়, দানশীল এবং জনকল্যাণমূলক কাজ করা যায়।
কোনো মুসলমান যদি ধর্মীয়, দাতব্য বা পবিত্র উদ্দেশ্যে তার সম্পত্তি চিরস্থায়ীভাবে উৎসর্গ করে নিজের স্বত্ত্ব বিলোপ করে এবং উক্ত স্বত্ত্ব আল্লাহর সমীপে সমর্পণ করে তবে ইসলামী আইন অনুযায়ী ওয়াকফ হিসাবে গণ্য হবে।
যিনি ওয়াকফ করেন তাকে ওয়াকিফ বলে। ওয়াকফ লিখিত দলিল বা মৌখিকেভাবে করা যায়। তবে ওয়াকফের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হতে হবে।
কোম্পানির শেয়ার, প্রমিসরি নোট কিংবা নগদ অর্থ ওয়াকফ করা যায়। সাবালক ও সুস্থতা সম্পন্ন ব্যক্তি ওয়াকফ করতে পারে।
১৯২৩ সালে ওয়াকফ বৈধকরণের জন্য ওয়াকফ ভ্যালিডিটি আইন জারি করা হয়। ১৯৩৪ সালে বঙ্গীয় ওয়াকফ আইন জারি করে ওয়াকফ সম্পত্তির তদারকি ও ব্যবস্থাপনা করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে ওয়াকফ অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। বর্তমানে এই আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালিত হয়। ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়াকফ প্রশাসকের একটি অফিস আছে।
পরিচালনা কমিটি গঠন ও ওয়াকফ তালিকাভূক্তির ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা আছে। ওয়াকফ দুই প্রকার।
ওয়াকফ-ই-লিল্লাহ
পরকালে শান্তির আশায় পূর্ণ অর্জনের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় ও সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির সম্পূর্ণ স্বত্ত্ব দান করা আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলে তাকে ওয়াকফ-ই-লিল্লাহ বলে। ওয়াকফ-ই-লিল্লাহ এর সম্পত্তির আয়ের অর্ধাংশের বেশি সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হয়। ওয়াকফ-ই-লিল্লাহ জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত সম্পত্তি।
ওয়াকফ-আল-আওলাদ
কোন সম্পত্তির মালিক তার সম্পত্তি নির্দিষ্ট অংশ ধর্মীয়, সৎকাজ বা জনহিতকর কাজের জন্য ব্যয় করার উদ্দেশ্যে দলিলের মাধ্যমে উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তি দান করলে তাকে ওয়াকফ-আল-আওলাদ বলে। ওয়াকফ-আল-আওলাদে সম্পত্তিরে আয়ের অর্ধাংশের কম ধর্মীয় কাজে ব্যয় হয়। বাকি অংশ উত্তরাধিকারীদের কল্যাণে ব্যয় হয়। মোতাওয়াল্লী ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপক।
মোতাওয়াল্লী
ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনার জন্য যে ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হয় তাকে মোতাওয়াল্লী বলে। মোতাওয়াল্লী ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। কোন সুস্থ সবল ব্যক্তিকে মোতাওয়াল্লী নিয়োগ করা যায়। ওয়াকিফ ইচ্ছা করলে তার সন্তান সন্ততি, উত্তারাধিকারী বা অন্য কাউকে মোতাওয়াল্লী নিয়োগ দিতে পারে। মোতাওয়াল্লী তিন বছরের উর্ধ্বকাল কৃষি জমি ইজারা দিতে পারে না। ওয়াকফ প্রশাসকের পূর্বানুমতি ছাড়া ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারে না। ১৯৮৬ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট বাংলাদেশে ১৫০৫৯৩ টি ওয়াকফ ষ্টেট আছে। তার মধ্যে ৯৭০৪৬টি রেজিষ্ট্রিকৃত, ৪৫৬০৭ টি মৌখিক ৭৯৪০টি ব্যবহারিক।
বাংলাদেশে মোট ২১৪৫৭৫.৪৬ একর ওয়াকফ সম্পত্তি আছে তার মধ্যে ২০০৮৪১.০৭ একর কৃষি জমি ও ১৩৭৩৪.৩৯ একর অকৃষি জমি।
সম্প্রতিক জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশে ১৪০০ ওয়াকফ সম্পত্তি ওয়াকফ প্রশাসকের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের আয় হতে মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, কবরস্থান, এতিমখানা, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং ধর্মীয় উৎসব পরিচালিত হয়ে আসছে।
ওয়াকফ প্রশাসন বর্তমানে ১৫০০ মসজিদ, ৭০০ মাদ্রাসা, ১০০ এতিমখানা, ৫টি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং নওমসুলিমদের জন্য কল্যাণ তহবিল পরিচালনা করছে।
Subscribe to:
Comments (Atom)
